করোনাকালে দেশে নতুন করে এক কোটি ৬৩ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে বলে জানিয়েছে সরকারের একমাত্র গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা সংস্থা (বিআইডিএস)। সংস্থাটি বলেছে, করোনার আগে দেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ২০ শতাংশ। করোনা শনাক্তের পর টানা দুই মাসের সাধারণ ছুটিতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে যাওয়ায় দারিদ্র্যের হার বেড়ে হয়ে গেছে ২৯ শতাংশ। অর্থাৎ দেশে এখন দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারীর সংখ্যা চার কোটি ৮০ লাখ।
করোনাকালে দেশের দারিদ্র্যের হার নিয়ে গবেষণাটি করেছেন বিআইডিএসের গবেষণা পরিচালক বিনায়ক সেন। গতকাল বুধবার এক ভার্চুয়াল সভায় গবেষণা প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন তিনি।
গবেষণা প্রতিবেদনে বিনায়ক সেন দেখিয়েছেন, করোনার কারণে গত চার মাসে যারা দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে, তাদের দারিদ্র্যসীমার ওপরে উঠে আসতে বিদ্যমান সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি তেমন কাজে আসবে না। কারণ বাংলাদেশে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির টার্গেট গ্রুপ ঠিক নেই।
আন্তর্জাতিক সংজ্ঞা অনুযায়ী, দৈনিক ১ দশমিক ৯০ ডলারের কম আয় যাদের তারাই দরিদ্র। বাংলাদেশ এই সংজ্ঞা গ্রহণ করেছে।
বিআইডিএসের মহাপরিচালক ড. কে এ এস মুরশিদের সঞ্চালনায় ভার্চুয়াল সভায় অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান, পরিকল্পনা বিভাগের সচিব আসাদুল ইসলাম, সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ড. মুশতাক হোসেন, অধ্যাপক এস আর ওসমানীসহ অন্যরা।
সভায় মোট চারটি প্রবন্ধ উপস্থাপন করা হয়।
দারিদ্র্যের হার নিয়ে করা গবেষণা প্রতিবেদনে বিনায়ক সেন বলেছেন, এ বছরের মধ্যে করোনাভাইরাস চলে গেলেও বছর শেষে দারিদ্র্যের হার ২৫ শতাংশের মধ্যে থাকবে। এর চেয়ে নিচে নামবে না। অথচ করোনার আগে দেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ২০ শতাংশের মধ্যে। প্রতিবেদনে দেখা গেছে, করোনার ফলে গ্রামের চেয়ে শহরের মানুষ বেশি দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে। গ্রামে যেখানে দারিদ্র্যের হার ২৭ শতাংশ, শহরে সেখানে ৩৫ শতাংশ। জাতিসংঘ ঘোষিত ১৫ বছর মেয়াদি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় (এসডিজি) ২০৩০ সালের মধ্যে দারিদ্র্যের হার শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার যে লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে, করোনার কারণে সেটি অর্জন বাংলাদেশের জন্য কঠিন হয়ে গেল বলে জানান বিনায়ক সেন। তাঁর গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশ যদি চলতি অর্থবছর থেকে টানা ১০ বছর মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশ করে অর্জন করে, তাহলেই কেবল এ লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব হবে। এখন থেকে প্রতিবছর যদি ৭ শতাংশ করে জিডিপির প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়, তাহলে ১০ বছর পর দারিদ্র্যের হার থাকবে ৬ শতাংশ। প্রবৃদ্ধি যদি ৬ শতাংশ করে অর্জিত হয়, তাহলে এ হার থাকবে ৮.৬ শতাংশ। আর যদি সাড়ে ৫ শতাংশ করে প্রবৃদ্ধি হয়, তাহলে ২০৩০ সালে দারিদ্র্যের হার থাকবে ১০ শতাংশ।
বিনায়ক সেন বলেন, করোনা এসে দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা যেভাবে লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে গেল, তাতে প্রতিবছর ৮ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন কঠিন। ফলে বাকি সময়ে অর্থাৎ ১০ বছরে দারিদ্র্যের হার শূন্যের কোঠায় (৩.১ শতাংশ) নামিয়ে আনাও অসম্ভব।
বিআইডিএসের মহাপরিচালক ড. কে এ এস মুরশিদের নেত্বত্বে অনলাইনভিত্তিক একটি জরিপ করা হয়। জরিপ পরিচালনায় অন্যদের মধ্যে ছিলেন বিআইডিএসের তিনজন গবেষক। তাঁরা হলেন তানভীর মাহমুদ, আবদুর রাজ্জাক সরকার ও নাহিয়ান আজাদ শশী। জরিপে অংশ নেওয়া ৩০ হাজার নাগরিকের মধ্যে ৭৪ শতাংশ বলেছে, করোনা থেকে রক্ষা পেতে সারা দেশে ‘লকডাউন’ অব্যাহত রাখা উচিত ছিল। জরিপে অংশ নেওয়া ১৩ শতাংশ বলেছে, করোনার কারণে তারা কর্মহীন হয়ে গেছে।
নাহিয়ান আজাদ শশী জানান, ৫ মে থেকে ২৯ মে পর্যন্ত তাঁরা জরিপটি পরিচালনা করেন। জরিপে অংশ নেওয়া ৪৩ শতাংশ ছিল উচ্চশিক্ষিত বা স্নাতকোত্তর উত্তীর্ণ। ১১ শতাংশ ছিল স্নাতক (সম্মান) উত্তীর্ণ। ১২ শতাংশ স্নাতক (পাস) পাস। জরিপে অংশ নেওয়া ২৩ শতাংশ বলেছে, তাদের বেতন ছিল পাঁচ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকার মধ্যে। করোনাকালে এপ্রিল মাসে তাদের বেতন ৫০ শতাংশ কমানো হয়েছে। ১৯ শতাংশ বলেছে, তাদের বেতন ৭৫ শতাংশ কমানো হয়েছে। ১৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা যাদের বেতন তাদের মধ্য থেকে ১৬ শতাংশ বলেছে, তাদের ২৫ শতাংশ বেতন কমানো হয়েছে।
জরিপে দেখা গেছে, করোনার কারণে সবচেয়ে বেশি কর্মহীন হয়েছে ঢাকা বিভাগে। এই হার ১৩.১৬ শতাংশ। এরপরে আছে সিলেট বিভাগ ১৩.১১ শতাংশ। এরপর আছে চট্টগ্রাম বিভাগ। জরিপে অংশ নেওয়া বড় একটি অংশ বলেছে, করোনা থেকে বাঁচতে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা কঠিন।
ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প নিয়ে আরেক জরিপে দেখা গেছে, করোনার কারণে যে দুই মাস দেশ সাধারণ ছুটি ছিল তাতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের ক্ষতি হয়েছে ৯২ হাজার কোটি টাকা।
বিআইডিএসের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো মনজুর হোসেনের গবেষণায় দেখা গেছে, সুদ পরিশোধ ছাড়াই ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে এই ৯২ হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে।
আলোচনায় অংশ নিয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, করোনার কারণে দারিদ্র্যের হার যেভাবে বেড়ে গেছে তা উদ্বেগের। তা ছাড়া ২০০০ থেকে ২০১০ ওই সময়ে যে হারে দেশে দারিদ্র্যের হার কমেছিল, ২০১০-এর পর থেকে সেই হারে দারিদ্র্যের হার কমছে না। এটাও উদ্বেগের, চিন্তার। বিষয়টিতে নজর দেওয়া জরুরি।