সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি নিউজ লাইন ৭১ বিডি::
কেমন আছেন লোকাল ট্রেনের সেই প্যাচালী বন্ধুরা? যারা হকার নামে পরিচিত। কতো বিচিত্র ভঙ্গি তাদের,কতো বৈচিত্রের সমাহার। কেউ কেউ বাচন ভঙ্গি আর স্টাইলে হয়ে ওঠেন অনন্য।অথচ তাদের কোনো মার্কেটিং ট্রেনিং নাই, নাই তদারকি ম্যানেজার।নিজেরাই তৈরী করেন পণ্য বিপণনের নানান চিত্তাকর্ষক পদ্ধতি।
ট্রেনে চা বিক্রি করেন ছফুর মিয়া।তিনি এসেই বলবেন, সম্মানিত যাত্রী ভাই বোন বন্ধুগন!আপনারা চা টা খেয়ে নিন। ভাই বিস্কুট টা ধরুন। বিকেলের ট্রেন। অনেক ডেইলি প্যাসেঞ্জার।ছফুর মিয়া জানে কারা চা খাবে। সে এই যে ভাই চা নিন বলে বলে চা দিচ্ছে পরপর। এক বয়স্ক ভদ্রলোক, তিনি নতুন, ভাবলেন ফ্রি তে চা বুঝি। তিনি নিজে নিলেন, গিন্নিকে ও দিলেন। গিন্নির খুব একটা ইচ্ছা ছিলো না। তবুও যেচে দিচ্ছে। খেলেন। এরপর যখন পয়সা দেবার সময় এলো, দেখার মতো হয়েছিলো ভদ্রলোকের মুখটা। না জানি আরো কতোজন এইভাবে ছফর মিয়ার চা খেয়েছেন
এক ফল ওয়ালা আছেন। হেবি মজার লোক। কাঁচা ছোলা বিক্রি করছেন একজন। এই যে ছোলা,এই যে ছোলা। ফলওয়ালা তার পেছন পেছন এলেন, কলা নিয়ে, এই যে আছোলা, এই যে আছোলা বলতে বলতে। লোক হেসেই অস্থির। ছোলা ওয়ালা রেগে যেতেই বলেন, কলা ছাড়ানো নয়, তাই আছোলা। একজন লেবু বিক্রি করছেন, লেবু রুগী বাচ্চা খাবে। তিনি এসেই শুরু করলেন, আমার লেবু মুরগি বাচ্চা খাবে। আবার হাসি সবার। এছাড়াও নানা আকর্ষণীয় অফার। আপেল নিন, ধান বেচে পয়সা, ডালিম নিন, আলু উঠলে পয়সা। লেবু নিন পুরনো নোটে দাম দিন। বেদানা খান, বেদনা কমান। নানা অফারের ছড়াছড়ি। একজন ফলের দাম শুনে আশ্চর্য হয়ে বললেন, বাবা!!! তৎক্ষণাৎ জবাব, বাবা বাড়িতে, ফল গাড়িতে। গুলিয়ে ফেলবেন না।
এছাড়া ছিলো মিলনীর চানাচুর। খেলে বেকার ছেলে চাকরি পাবে,ফেল করা পাশ করবে, এক দেখায় মেয়ের বিয়ে হবে। লোক আশ্চর্য হয়ে শুনতো। কে না খায় সেই চানাচুর। সেই হরিদাসের বুলবুল ভাজা স্টাইল,” মহারানী ভিক্টোরিয়া, এ ভাজা খান রোজ কিনিয়া।” বলার গুনে বিক্রিও হতো বেশ। তাদেরই এক ভাই আসতেন, চানাচুর, চানাচুর বলে এগিয়ে যেতেন, পিছন থেকে কেউ যদি চাইতেন, বলতেন, আর হবে না।এক অজ্ঞাত কারণে পিছনে ফিরে এসে আর বিক্রি করতেন না। লোকে হেবি মজা নিত।
একজন ছিলেন সন্তোষ চক্রবর্তী। হজমি গুলি বিক্রি করতেন। কি কনফিডেন্স। রাইফেলের গুলি মিস হবে, কিন্তু সন্তোষ চক্রবর্তীর গুলি মিস হবে না। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস কামরা শুদ্ধ লোককে ফ্রি তে গুলি খাওয়াতেন। পাবলিক ও তেমনি, রোজ হাত পেতে খেতো, কিন্তু বেশিরভাগই কিনত না। কিভাবে চলতো তার কে জানে।
একজন পুরোনো ম্যাগাজিন বিক্রি করতেন। আনন্দমেলা, শুকতারা, দেশ ইত্যাদি 2/5 টাকায় বিক্রি হতো। সে উঠলেই লোক চিৎকার করতো 5 টাকায় দেশ বেচে দিচ্ছ। সেও রাগে চিৎকার করতো। শেষে এমন হলো, যে কামরায় যান, সেখানেই এক প্রশ্ন। বই বিক্রি ছেড়েই দিলেন বেচারা।
একজন গুড় কাঠি বা কাঠি গজা বিক্রি করেন। তিনি এককালে বলতেন, গজা নিন ঘিয়ে ভাজা। একদিন একজন ডাকলো, এই ঘিয়ে ভাজা এদিকে দেখি।তিনি রেগে গেলেন, ঘিয়ে ভাজা বললেন কেনো? ব্যাস লোকে খোরাক পেয়ে গেলো। তিনি উঠলেই সমস্বরে চিৎকার, এই ঘিয়ে ভাজা। গালাগালির ঝড়। বেচারা প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকলেও ট্রেন থেকে প্রবল চিৎকার ভেসে আসে, ঘিয়ে ভাজা, ঘিয়ে ভাজা।
একজন বই বিক্রি করেন। মানুষকে বশ করার উপায়। দারুন কায়দা তার। চটি বই পিন আপ করা।সূচিপত্র ছাড়া কিছু দেখা যাবে না। বইটি কিনে ট্রেনে পড়া যাবে না। বাড়িতে একলা পড়তে হবে।কাউকে দিলে কাজ হবে না। দারুন বিক্রি।লোকে ভাবে মন্ত্র তন্ত্র।আসলে কিচ্ছু না, কিভাবে মানুষের সাথে কথা বলতে হয়, তার উপায়। প্রচারের কায়দা দেখার মতো। সেই গুনেই হট কেকের মত বিক্রি।
একজন আসেন চপ নিয়ে। কতো অভুক্ত মানুষের খাদ্য ওই গরমাগরম চপ আর এক ঠোঙা মুড়ি।সাথে কাঁচা লংকা ফ্রি। কিন্তু তাঁর দোষ, দাদা নিমপাতার চপ আছে বললেই, বিক্রি ছেড়ে ঝগড়ায় মত্ত। মেজাজ গরম, চপ ঠান্ডা।
আসতেন এক বয়স্ক ব্যক্তি। লজেন্স বিক্রি করতেন। এসেই শুরু করতেন, আর কারো ঠকবার ইচ্ছে আছে? সেই আশি থেকে দু’হাজার কুড়ি, একটানা চল্লিশ বছর, রেল গাড়িতে রেকর্ড।
একজন কে দেখি মাশরুম বিক্রি করেন, সুর করে বলেন, মাশরুম আছে, প্রোটিন আছে, ছাতু আছে। খান দাদা খান, খেলেই আপনারা পাবেন প্রোটিন,আমি পাবো ভাত।
আর একজন এসেই বলতেন, স্বপন এসে গেছে। স্বপন আপনাদের সকলের কুশল কামনা করছে। নিজেদের মধ্যে বিবাদ করবেন না। ঝঞ্ঝাট ঝামেলা সংসারে থাকবেই, ওপরওয়ালার ওপর ভরসা রাখুন, আর মুখে হাসি থাকুক, সব বিপদ কেটে যাবে। স্বপন বাবুর বাচন ভঙ্গি লোককে বেশ স্বস্তি দিতো। তিনি লজেন্স বিক্রি করতেন।খুচরোর আকালের সময়ও 1 টাকার লজেন্স কিনলে 100 টাকার খুচরো করে দিতেন।
একজন এসেই বলতেন দাদারা দিদিরা আপনার মাথার চুল থেকে পায়ের নখ, সব দায়িত্ব আমার। চুল আঁচড়ানোর চিরুনি, কপালের টিপ, চোখের কাজল,কানের বাড, পিঠ চুলকানোর প্লাস্টিক হাত, গোড়ালি ঘষা ব্রাশ, নখ কাটার যন্ত্র সব আমি দেবো। আপনার পুরোটাই আমার কাঁধে।
এইরকম বিচিত্র অভিজ্ঞতার ঝুলি নিয়ে আসেন ট্রেনের হকার দল। কতো বিচিত্র জিনিস, কতো আকর্ষণীয় বাচন ভঙ্গি। দেবো নাকি দাদা, ছাল ছাড়িয়ে নুন মাখিয়ে? কচি শশা। অথবা এই যে দাদারা ছারপোকার বাচ্চারা বিছের বংশরা। ……..। যদি আপনাকে কামড়ায়, লাগান এই বিষহরি তেল। বলার গুনে কামরার হট্টগোল যায় থেমে, আকর্ষণ করার ক্ষমতা আর রসবোধ দেখে অবাক হতে হয়। কেনা বেচার সম্পর্ক ছড়িয়ে অনেকেই হয়ে ওঠেন প্রাণের বন্ধু। খবরাখবর নেন, ভালো আম টা, লেবু টা বেছে দেন। ভাঁড় শেষ হবার পর ঢেলে দেন ভালোবাসার ফ্রী চা।
অনেক দিন দেখিনা তাঁদের।ট্রেন বন্ধ হয়েছে প্রায় তিন মাস পেরিয়ে গেলো। জানিনা কোথায় কেমন আছেন তারা?সেই স্বপন দা হাসি মুখেই আছেন আশা করি। মাশরুমের বিক্রেতার ঘরের ভাত কিভাবে আসছে? চালের পাঁপড় বিক্রেতার ঘরে চাল,আর ঘরের চালের খবর কী? বয়স্ক লজেন্স দাদু নিজেই বুঝি ঠকে যাচ্ছেন রোজ। পাঁচ টাকার দেশ পত্রিকা বেচা মানুষটার খবর কী রাখে দেশ? মজা করে ধান বেচে পয়সা বলা মানুষটার ঘটি বাটি বেচতে হচ্ছে না তো?
তারা সবাই আকুল হয়ে তাকিয়ে আছেন শূন্য রেল কামরার দিকে। রেল চললেই চলে তাদের সংসার। অচল সংসারের চাকাটা বড়ো ভারী লাগে,বউ সন্তান টানা বড়ো কষ্টকর।
জানিনা কেমন আছেন সেই স্বপ্নের ফেরিওয়ালারা। দেশে লকডাউন চলছে।বড়ো দুঃসময় এখন তাদের। ভালো থাকুন তারা।এই দুয়া করছি মহান আল্লাহর কাছে।আমিন।
নিজস্ব পোস্ট।তবে কিছু থিংক ও কিছু ভাষা বা কিছু কথা সংগৃহিত।(মন্তব্য কমেন্ট বক্সে)। @মারুফ@
ছবিঃ কালেক্টেড।